জীবনে সময়ের মূল্য নিয়ে রচনা পড়ে নাই এমন মানুষ পাওয়া দুষ্কর। সময়ের মূল্য নিয়ে সচেতনতা সেখান থেকেই শুরু। সময়ের সঠিক ব্যাবহার আমাদের উন্নতির শিখরে নিয়ে যায়। এসব তত্ত্ব কথা শিখেছি কিনা বলা মুশকিল তবে মুখস্ত করে পরীক্ষায় লিখে ভাল মার্কা পেয়েছি সন্দেহ নাই। সময়ের মূল্য আমরা যেভাবে শিখি আমি সেটাতে একটু দ্বিমত পোষণ করি। এই লেখাতে আমি সেটাই কয়েকটি ঐতিহাসিক ঘটনা উল্লেখ পূর্বক আলোচনা করার চেষ্টা করব। আর সে কারণেই আলোচনাটি দীর্ঘ হতে পারে। প্রথমে বৈদ্যুতিক বাল্ব আবিষ্কারের কথা বলব। টমাস আলভা এডিসনকে বৈদ্যুতিক বাল্বের আবিষ্কারক বলা হলেও সেটা পুরোপুরি ঠিক নয়। এডিসনের আগে অন্তত ২০ জন বিজ্ঞানী বাল্ব নিয়ে গবেষণা করেন, ১৮০২ সালে হামপ্রে ড্যাভি প্রথম বিদ্যুৎ দিয়ে আলো জ্বালাতে সক্ষম হন। তার পর দীর্ঘ গবেষণা হয়। ১৮৭৯ সালে এডিসন আধুনিক বাল্ব উদ্ভাবন করেন, সেজন্যই তাঁকে বৈদ্যুতিক বাল্বের আবিষ্কারক/ জনক বলা হয়। সকল নতুন আবিষ্কারেই যিনি সফল হন তাকেই জনক বলা হয়। কথিত আছে তিনি ১০ হাজার বার ব্যার্থ হন। সত্যিকার অর্থে কেউ ব্যার্থতা গুনেগুনে গবেষণা করেন না, সম্ভবত সংখ্যাটি দিয়ে অসংখ্যবার ব্যার্থতার দিকেই ইঙ্গিত করেছেন । এই প্রসঙ্গে পরে তিনি বলেন “আমি ১০ হাজার বার ব্যর্থ হইনি, আমি বাল্বটি ভাল কাজ না করার ১০ হাজারটি কারণ বের করেছি। আচ্ছা ভাবুনতো এডিসন যদি সাড়ে ৯ হাজার বার চেষ্টা করে থেমে যেতেন আর বলতেন অযাথা সময় নষ্ট হচ্ছে, অন্য কোন কাজে মন দেই তাহলে কি আমরা আজকের বৈদ্যুতিক আলো পেতাম? হয়ত পেতাম না, পেলেও আরও অনেক পরে অন্য কারও হাত ধরে। ১৮৮০ সালের জানুয়ারিতে তিনি সারা পৃথিবীতে বিদ্যুৎ ও আলো পৌঁছে দেওয়ার লক্ষে “এডিসন ইল্যুমিনেটিং কোম্পানি” প্রতিষ্ঠা করেন। পরে কোম্পানিটি “জেনারেল ইলেকট্রিক কর্পোরেশন” নামে পরিচিতি পায়। এডিসন তার আবিষ্কারে দীর্ঘ সময় ব্যায় করেছেন একই সাথে অসংখ্যবার ব্যার্থতা সামলে নিয়েছেন একটা সুন্দর ও গ্রহনযোগ্য ফলাফলের আশায়। তিনি সার্থক না হতে পারলে হয়ত আরও সময় দিতেন। এখানে প্রতীয়মান এডিসন সময়ের চেয়ে কাজের গুরুত্ব অনেক বেশি দিয়েছেন। দ্বিতীয় উদাহরণ হিসেবে উড়োজাহাজ/বিমান আবিষ্কারের দিকে দৃষ্টিপাত করব। পৌরাণিক কাহিনী বা রূপকথা থকে জানতে পারি হাজার হাজার বছর আগে থেকেই মানুষ আকাশে উড়বার বাসনা করেছে । ইতিহাসে উড়নযন্ত্রের প্রথম নকশা পাই লিওনার্দো দা ভিঞ্চি থেকে ১৪৮৮ সালে। অটো লিলিয়ানথাল, জন স্ট্রিংফেলোসহ অনেক বিজ্ঞানীই বিমান আবিষ্কার নিয়ে কাজ করেছেন। এমনকি ভারতে শিবকর তলপড়ে নামক একজন বিজ্ঞানী ১৮৯৫ সালে মানুষ (যাত্রী) বিহীন বিমান প্রায় ১৮ মিনিট ওড়ান। পরবর্তীতে অর্থাভাবে তিনি গবেষণার সফলতা আনতে পারেন নাই। বিমান আবিষ্কারের সফলতা আসে রাইট ভ্রাতৃদ্বয়ের হাত ধরে। রাইট ভ্রাতৃদ্বয় (উইলবার রাইট এবং অরভিল রাইট) প্রথম ১৮৯৯ সালে ঘুড়িতে পাখা লাগিয়ে উড়াতে চেষ্টা করেন। পরের বছর তাঁরা আর একটি উড্ডয়ন ঘটান যা মাত্র ১২ সেকেন্ড স্থায়ী হয়। অ্যামেরিকার সেনাবাহিনী ও ফ্রান্স সরকারের অর্থ সহযোগিতা নিয়ে ১৭ ডিসেম্বর ১৯০৩ সালে Wright Flyer-এ ৬ কিলোমিটার ভ্রমন করেন। অব্যাহত চেষ্টার ফলে ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে তৈরিকৃত Flyer-111-এ ১০৫ বার উড্ডয়ন করেন। অরভিল যুক্তরাষ্ট্রে ১৯০৮-এর ৯ সেপ্টেম্বর সফলভাবে বিমানের একাকী এক ঘণ্টা ২ মিনিট ১৫ সেকেন্ড একটানা ভ্রমণ করেন। ১৭ সেপ্টেম্বর সেনাবাহিনীর লেফটেন্যান্ট টমাস সেলফ্রিজকে সঙ্গী করে ওড়ার সময় একশ ফুট ওপরে প্রোপেলার ফেটে গেলে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মাটিতে আছড়ে পড়েন। সেলফ্রিজের মৃত্যু হলেও অরভিল বেঁচে যান। এটিই বিমান দুর্ঘটনায় প্রথম মৃত্যু। অব্যাহত গবেষণার ফলে প্রথম বাণিজ্যিক বিমান চালু হয় ১৯১৪ সালের ১লা জানুয়ারী। এই উদাহরণেও আমরা দেখতে পাচ্ছি সময়ের চেয়ে কাজটিই মুখ্য হয়ে উঠছে। কোন বিজ্ঞানীই চেষ্টা করেন নাই নির্দিষ্ট সময়েই কাজ শেষ করতে। তাঁরা কাজ শুরু করেছেন গুরুত্ব বুঝে আর ভেবেছেন নিজে সফল না হলে পরবর্তী কোন না কোন প্রজন্ম সফল হবে।
মহাভারতের দিকে তাকালেও দেখতে পাই অর্জুন
শ্রেষ্ঠ ধনুর্বীর হওয়ার জন্য সূর্যাস্তের পরও
ধনুর্বিদ্যা অনুশীলন করছেন। একই রকম কাজের প্রতি ভালোবাসা আর কাজের প্রতি নিবেদন দেখতে
পাই কর্ণের ক্ষেত্রেও। গুরু দ্রোণের সরাসরি শিক্ষা না পেয়েও একলব্যের বিদ্যার প্রতি
একনিষ্ঠ সমর্পণ তাকে অনন্য উচ্চতায় নিয়েছিল । সুতরাং কেউই নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কাজ
শেষ করতে চান নাই বরং শুধুই কাজের মুল্য বুঝে সময়, মেধা, শ্রম সমর্পণ করেছেন এবং কাঙ্ক্ষিত
সাফল্য অর্জন করতে পেরেছেন।
আমরা বঙ্গবন্ধুর প্রসঙ্গ আনতে পারি। ১৭৫৭ সালে বাঙ্গালির স্বাধীনতা অস্তমিত
হওয়ার পর থেকে স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারে অনেক মহান নেতা কাজ করেছেন। সেই মিছিলে বঙ্গবন্ধুও
যুক্ত হন মাত্র ১৪ বছর বয়সে ছাত্র রাজনীতির মাধ্যমে। ১৯৩৪ সালে রাজনীতি শুরু করে দীর্ঘ
সময় ক্ষমতার বাইরে থেকে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার মাধ্যমে প্রথম ক্ষমতার
কাছাকাছি আসেন। যদিও এই মহান নেতা ক্ষমতাকে দায়িত্ব হিসেবেই জানতেন। বাংলা ও বাঙ্গালির
মুক্তি ব্যাতিত অন্য কোন ইচ্ছে থাকলে তিনি জেলের ঘানি টেনে এত দীর্ঘ সময় রাজনীতি করতেন
না। বঙ্গবন্ধুর কাছে বাংলা ও বাঙ্গালির মুক্তি ছিল একমাত্র ধ্যান ও জ্ঞান। সেজন্যই
বছরের পর বছর সময় ব্যায় করেছেন অভীষ্ট লক্ষে পৌঁছাতে। জনসচেতনা থেকে শুরু করে নানাবিধ
কর্মসূচির মাধ্যমে তিনি একটু একটু করে তার সুনির্ধারিত কাজকে সার্থক করেছেন। আমরা স্বাধীনতা
পেয়েছি। বঙ্গবন্ধুও সময়ের চেয়ে কাজের মূল্যটাই
বুঝলেন সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে। একই ভাবে পৃথিবীর ভাল/বড় কাজ, আবিষ্কার, বিভিন্ন দেশের
স্বাধীনতার দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই সময় সেখানে অনেকটাই অগুরুত্বপূর্ণ। এমনকি খারাপ
কাজের দিকে তাকালেও একই চিত্র চোখে পড়বে। কেউ যদি দক্ষ চোর হতে চায় তাকেও চুরি করাটাকেই
সর্বোচ্চ ভালবাসতে হবে।
তাহলে কি সময়ের কোন মূল্য নাই? আছে। অবশ্যই
আছে। একটা কাজ করতে অনেক গুলো উপাদান (Raw material) লাগে যেমন সময়, মেধা, শ্রম, অর্থ
ইত্যাদি। আমরা কোন উপাদানকেই অপচয় করতে পারিনা। এখানে সবগুলোই মূল্যবান উপাদান হিসেবে
পূজিত। কাজের সঠিক মূল্য বুঝতে পারলে উপাদান সমূহ (সময়, মেধা, শ্রম, অর্থ) বিনিয়োগ সহজ হয় এবং সর্বোত্তম ব্যাবহার
নিশ্চিত করতে মনোনিবেশ করা যায়। কাজের গুরুত্ব না বুঝে মানুষ যখন শুধুই সময়ের মূল্য
নিয়ে ভাবে তখন তার চঞ্চল মন গুরুত্বপূর্ণ কাজকেই অগুরুত্বপূর্ণ করে তোলে। যেমন কোন
ছাত্রকে একটা তুলনা মূলক কঠিন বিষয় অধ্যয়ন করতে হলেই বলে অযাথা সময় নষ্ট হচ্ছে অথচ
সেটা গুরুত্বপূর্ণ। পৃথিবীর সকল মানুষ যদি অন্তত একটা করে ভাল কাজ করত তাহলে পৃথিবী
আরও সুন্দর হতো অথচ সময়ের মূল্যর প্রতি সবারই কম বেশি নজর ছিল এবং জীবনকালে প্রত্যেকটা
মানুষই অন্তত কয়েক হাজার বার “সময় নষ্ট হচ্ছে” এই কথাটা উচ্চারণ করে। তাহলে কি “সময়
নষ্ট হচ্ছে” বলা যাবে না? আলবাত যাবে। কিন্তু একটা কাজের উপাদান হিসেবে সময় নষ্ট হচ্ছে
এই উপলব্ধিটুকু থাকতে হবে। আমরা সময়ের মূল্য দিতে চাইলেও কিভাবে দিতে হবে এবং কোন অনুসঙ্গে
দিতে হবে বা সময়ের মূল্য বলতে আসলেই কি বোঝায় সেটা বুঝিনা। “সময় নষ্ট হচ্ছে” অথবা
“সময়ের মূল্য নাই” এই কথা বলা প্রবন্ধের উদ্দেশ্য নয়। প্রবন্ধের উদ্দেশ্য কাজের সাথে
সময়কে সম্পর্কিত করে, কাজের মূল্যায়নের মাধ্যমে সময়কে মূল্যবান ও শক্তিশালী করা। সময়কে
নিরঙ্কুস (Absolute) মূল্যবান না ভেবে কাজকে নিরঙ্কুস (Absolute) মূল্যবানের স্থানে
বসিয়ে সময়কে কাজের অন্যতম উপাদান হিসেবে অন্য সকল উপাদানের মতই সর্বোচ্চ যত্ন করতে
হবে।
মোঃ মেনহাজুল আবেদীন
সহকারী অধ্যাপক,
পরিসংখ্যান ডিসিপ্লিন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়।
ও
পিএইচডি গবেষক
হোক্কাইদো বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান।
বিডাকঃ menhaz@ku.ac.bd
তারিখঃ ১৮ জুলাই, ২০২০