Saturday, February 20, 2021

রূপকথা গণিত ও বিজ্ঞান শিক্ষা

রূপকথার গল্প কিভাবে আষাঢ়ে গল্প হিসেবে পরিচিতি পেল সেটা আমার জানা নাই। ধারণা করি আষাঢ়ে বৃষ্টির অলস দিনগুলিতে গ্রামের মানুষ খানকা বা টং ঘরে বসে তামাক/হুক্কা টেনে সময় পার করার পাশাপাশি এসব গল্প চর্চা করতেন। একই সাথে চলত ঘরের নানা কাজ, যেমন দড়ি বানানো, মাছ ধরার জাল বুনানো ইত্যাদি।  একই আসরে  সুর করে পুঁথি/কিতাব পড়াও চলত। নারী পুরুষ নির্বিশেষে সবাই এসব গল্পের চর্চা করতেন। যেহেতু বেশির ভাগ মানুষ গরিব/অভাবী ছিল সম্ভবত সেজন্যই রাজা-রাজড়ার গল্প বেশি হত। চরম অর্থ কষ্টে থেকে তারা ভাবতেন একদিন সুখের দিন আসবে। এসব গল্পের ভিতর দিয়ে তারা বিভিন্ন উপদেশ দেওয়ারও চেষ্টা করতেন। তারা দেখাতেন রাজপুত্রের অনেক সম্পদ থাকলেও বুদ্ধিতে কখনও কখনও গরিবের পুত্রের কাছে হেরে যায়। তারা বলার চেষ্টা করতেন মস্তিষ্ক উন্নত করার জন্য আর্থিক প্রাচুর্য থাকা উপকারী তবে আবশ্যক নয়। সেসব আসরে তারা নতুন কিছু আবিষ্কার বা স্বয়ংক্রিয় কিছু তৈরি করারও স্বপ্ন দেখতেন। হয়ত যেসব কাজ করতে অনেক পরিশ্রম আর কষ্ট করতে হতো সে সব কাজকে স্বয়ংক্রিয় করতে চাইতেন। যেমন রাজার বাড়ির সদর দরজা খুলতে যখন বেশ কয়েক জন  দ্বাররক্ষীর  প্রয়োজন, তখন তারা একটা গল্প তৈরি করলেন যেখানে কেউ বলা মাত্রই দরজা খুলে যাবে বা বলবে চিচিং ফাঁক। গল্পের চরিত্র গুলো নিমেষেই পাহাড়ে উঠতে পারত, সমুদ্র পাড়ি দিতে পারত, অন্ধকারে চলতে পারত ইত্যাদি। আমরা দেখতে পাই রূপার কাঠি ছোঁয়ালে রাজকন্যা ঘুমিয়ে পড়ত আর সোনার কাঠি ছোঁয়ালে রাজকন্যা জেগে উঠত।  

এসব গল্প নিবিষ্ট চিত্তে পাঠ করলে দারুণ সব পাঠোদ্ধার উপাদান পাওয়া  যায়। এই গল্প গুলো আমাদের ভাবতে সাহায্য করে, ভাবাতে সাহায্য করে, স্বপ্ন দেখতে সাহায্য করে। মায়ের বা দাদির কাছে ঘুমাতে ঘুমাতে যে ছোট্ট বাচ্চাটি কোমল মন নিয়ে  পাহাড়, সমুদ্র, আকাশ জয়ের গল্প শোনে, নতুন কিছু আবিষ্কারের গল্প শোনে, গল্পে গল্পে নীতি কথা শোনে সে অবশই তখন বড় হওয়ারও স্বপ্ন দেখে। এটা সত্য যে আমরা সন্তানদের পাঠোদ্ধার বা গল্পের মর্ম শেখাতে পারি না। আর এই সুযোগে কিছু আধুনিক নামধারী শিক্ষিত মানুষ রূপকথার গল্পকে গাঁজাখুরি, সেকেলে আর অরুচিকর নাম দিয়ে এর রস থেকে আমাদের সন্তানদের বঞ্চিত করছে। বুদ্ধিবৃত্তি বাড়ানোর বাণিজ্যিক প্রচারণা করে তুলে দিচ্ছি ভয়ঙ্কর ভিডিও গেম, যেখানে গুলি করা, বোমা বিস্ফোরণ, প্রতিপক্ষের শহর নষ্ট, প্রতিপক্ষের গাড়ি ভেঙ্গে ফেলা ইত্যাদিই  মূল বিষয়। ধারণা করি, একটা গেমও পাওয়া যাবে না যেখানে মানবিকতা আছে। নতুন প্রজন্মের মায়েরা এসব গল্প চর্চাও করছেন না, সন্তানদেরও শোনাচ্ছেন না। বিষয়টি আন্দাজ করেই হয়তো রবীন্দ্রানাথ ঠাকুর দক্ষিনারঞ্জন মিত্রের ঠাকুরমার ঝুলি-র ভুমিকায় লিখেছেন “ঠাকুরমার ঝুলিটির মত এত বড় স্বদেশী জিনিস আমাদের দেশে আর কি আছে? কিন্তু হায় এই মোহন ঝুলিটিও ইদানীং ম্যানচেস্টারের কল হইতে তৈরি হইয়া আসিতেছিল। এখনকার কালে বিলাতের “Fairy Tales” আমাদের ছেলেদের একমাত্র গতি হইয়া উঠিবার উপক্রম করিয়াছে। স্বদেশের দিদিমা কোম্পানি একেবারে দেউলে।”

রূপকথার গল্প একটা মানুষের ভাবালুতাকে দারুন ভাবে নাড়াতে পারে, ভাবাতে পারে, স্বাপ্নিক করে তুলতে পারে। গল্প শোনা,  বলা ও পড়ার অভ্যাস অন্যান্য বিষয় আত্মস্ত করতে সাহায্য করে। বঙ্গ সন্তানদের রূপকথার গল্পের পাঠোদ্ধার করার সামর্থ্য তৈরি হয় না বলেই তারা গণিত ও বিজ্ঞান চর্চায়ও পারঙ্গম নয়। আমি মনে করি পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় রূপকথার গল্পের বই হচ্ছে গণিতের বই, যার প্রত্যেকটা বাক্যই রূপকথা, প্রত্যেকটা গল্পই রূপকথা। ধরা যাক কিছু চলক (Variable)  X, Y বা Z, এগুলো আসলে কি? এগুলো বাস্তব জীবনের ওজন, উচ্চতা, বেগ, চাপ, তাপ, তাপমাত্রা, গভীরতা, গাড়ির সংখ্যা, মেইলের সংখ্যা, ছবির সংখ্যা, পিক্সেলের সংখ্যা, মানুষের সংখ্যা, কোষের সংখ্যা, কোষের গতি, বিমানের গতি, বাতাসের গতি, পানির গতি,  রক্তের গতি, মাছের গতি, পাখির গতি, কিট-পতজ্ঞের জীবন ধারন, ইন্টারনেটের বাফারিং সহ কত কি। ঠিক রূপকথায় যেমন কোন বিশেষ গল্প দিয়ে বিশেষ বিষয়কে রূপক ভাবে উপস্থাপন করা হয় তেমনি গণিতেও চলক দ্বারা বাস্তব জীবনের বিষয় গুলোকে প্রকাশ ও সমাধান করা হয়। বিমূর্ত গণিত (Abstract Mathematics), ফলিত গণিত (Applied Mathematics), পরিসংখ্যান (Statistics)-সহ সকল গাণিতিক বিষয়ে কল্পনা করাই মূল বিষয়। কল্পনা শক্তিকে জাগ্রত করতে না পারলে বিজ্ঞান চর্চা থমকে থাকবে। নবম -দশম শ্রেণীতে ব্রাউনীয় গতির (Brownian motion) আলোচনায় পোলেন কণার কথা বলা ছিল। এই পোলেন কণা গুলোকে যদি মানুষ, পাখি, শরীরের কোষ, মাছ, পশু, পতজ্ঞ, গ্যাসের কণা, ধূলিকণা, বিষের কণা ইত্যাদি ধরা হয় তাহলে ঐ ব্রাউনীয় গতির গণিত দিয়েই এই সকল বিষয়কে ব্যাখা করা যেতে পারে। এখানে পোলেন কণা গুলোকে রূপক ধরে নিয়ে ব্রাউনীয় গতির সমীকরণ তৈরি করা হয়েছে। মনে রাখতে হবে মাছের ঝাঁকের জন্য যে সমীকরণ হবে সেটা মানব শরীরের কোষের জন্য শতভাগ একই হবে না, কিছু পরিমার্জন পরিবর্ধন হবে। আবার স্নায়ু কোষের জন্য যে গণিত হবে সেটা সরাসরি অন্য কোষের জন্য নাও হতে পারে। পরিসংখ্যানের একটা খুব পরিচিতি উদাহরণ পয়সা টস, যেখানে হ্যাঁ  বা না (Success and failure অথবা True and False) দেখান যায়। এখানে পয়সা টস একটা রূপক ধারণা, পৃথিবীতে যে যে ধরনের ঘটনা যেগুলোতে হ্যাঁ বা না এর ধারণা আছে সে সমস্ত সমস্যাকে পয়সা টসের গণিত নিয়ে প্রকাশ ও তার সমাধান করা যেতে পারে। একই ধারণাটি বুলিয়ান বীজগণিতেরও (Boolean Algebra) মূল। বুলিয়ান বীজগণিতের বিষয়টা চমৎকার,  এই গণিতে ধরে নেওয়া হয় গণিত হবে খুব সহজ, সেখানে  হ্যাঁ বা না (Success and failure অথবা True and False) দিয়ে সবকিছুকে প্রকাশ করা হবে। বর্তমান সময়ের ডিজিটাল প্রযুক্তি এই গণিতের উপর দাঁড়িয়ে আছে। এটা আসলে গানিতিক যুক্তি বিদ্যা। স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তিগুলোকে (যেমন দরজা খোলা, আলো জ্বলা, গাড়ি চালান, ড্রোন চালনা, অস্ত্র চালনা ইত্যাদি)  গানিতিক যুক্তি বা  বুলিয়ান বীজগণিতের মাধ্যমে উদ্ভাবন করা হয়। অনেক সময় আমরা গাণিতিক ভাবে প্রমাণিত কোন বিষয়কে সত্য ধরে নেই সেটাও সবসময় ঠিক নয়। গণিত যেহেতু একটা ভাষা মাত্র তাই অন্য সকল ভাষার মতই গণিত দিয়েও মিথ্যা কথা বলা যায়। যেমন যখন বিশ্বাস করা হত সূর্য পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করছে তখন সে অনুযায়ীই গণিত লেখা হয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে সেটা অচল। গণিত বা বিজ্ঞান চর্চার জন্য দরকার কল্পনা আর প্রকৃতিকে দেখা। মানুষ প্রকৃতিকে যত নিবিড় ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে পারছে, যত ভালো ভাবে কল্পনা করতে পারছে গণিত বা বিজ্ঞান নামক ভাষাটি ততই যৌবন পাচ্ছে। সুতরাং, কিশোর বা কৈশোরে রূপকথা, যুবক বয়সে সাহিত্য পড়া উত্তম কল্পনা শক্তি বা ভাবালুতাকে সৃষ্টি করে এবং প্রকৃতিকে নিবিড় ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে সহায়তা করে যা পরবর্তীতে গণিতের পাঠোদ্ধার, আবিষ্কারের নেশায় মত্ত করে। মানবিক মানুষ আর বিজ্ঞানময় পৃথিবী গড়তে পায় নতুন মাত্রা।

মেনহাজুল আবেদীন

শিক্ষক, পরিসংখ্যান ডিসিপ্লিন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়

বিডাকঃ menhaz70@gmail.com 

সময়ের মূল্য কতটা ?

  জীবনে সময়ের মূল্য নিয়ে রচনা পড়ে নাই এমন মানুষ পাওয়া দুষ্কর। সময়ের মূল্য নিয়ে সচেতনতা সেখান থেকেই শুরু। সময়ের সঠিক ব্যাবহার আমাদের উন্নতির ...